নিবন্ধন সনদ ও নিয়োগ সুপারিশ জালিয়াতিতে তিন মাদ্রাসা শিক্ষক

বেসরকারি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার একজন অধ্যক্ষ এবং একজন সহকারী অধ্যাপক বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল এবং নিয়োগ সুপারিশ জালিয়াত চক্রের হোতা। আর এই দুজনের জালিয়াতির কাজে কারিগরিসহ সার্বিক সহযোগিতা করতেন আইসিটির শিক্ষক হিসেবে পরিচিত এক ব্যক্তি। শুধু মাদ্রাসা শিক্ষকদের নয় স্কুল-কলেজের শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ ও নিয়োগ সুপারিশ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এই তিনজন। 

তিনজনের চক্রটি কয়েক বছর থেকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ও শিক্ষক নিয়োগের জাল সুপারিশ তৈরি করে চাকরি ব্যবস্থা করে দিতেন। জাল কাগজপত্রে এমপিও ছাড়ের ব্যবস্থা করতেও সহযোগিতা করেন তারা। এই তিনজন হলেন— গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মো. আশরাফুল আলম এবং কাপাসিয়ার সোহাগপুর আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ ন ম আব্দুল্লাহ এবং আইসিটি শিক্ষক হিসেবে পরিচিত সুমন।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর বলছে— দুই মাদ্রাসা শিক্ষকসহ তিনজন শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ও নিয়োগ সুপারিশ জালিয়াত চক্রের মূল হোতা। তারা শিক্ষকদের জালিয়াতির কথা জানিয়ে এবং জালিয়াতির কথা না জানিয়ে দুইভাবে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল এবং বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সুপারিশ তৈরি করে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতেন। নিয়োগের পর শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হয়ে যেতেন। শুধু তাই নয়, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের মোবাইল ফোন ক্লোন করে নিয়োগ সুপারিশের ম্যাসেজও পাঠাতেন, যা ভুয়া। এই চক্রের সন্ধান পাওয়ার পর দেড় শতাধিক শিক্ষকের জালিয়াতির ধরা পড়ে এবং তাদের এমপিও বাতিল করা হয়।

যেভাবে চক্রের সন্ধান মেলে

মাদ্রাসা শিক্ষায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর। অভিযানের অংশ হিসেবে ২০২৪ সালে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বড়িবাড়ি দাখিল মাদ্রাসার চারজন শিক্ষকের জাল সনদের সন্ধান মেলে।

এই চারজন শিক্ষক হচ্ছেন— মেজবাহ উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম এবং হাছিনা আক্তার। এই চার শিক্ষকের মধ্যে শফিকুল ইসলাম দাবি করেন তার সনদ সঠিক। সনদ সঠিক দাবি করে জানান, এনটিআরসিএ ওয়েবসাইটে তার প্রমাণ আছে। ফলাফল পেয়েছি এনটিআরসিএ মোবাইল নম্বর থেকে।

এই শিক্ষকের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের ওই সময়ের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন জানতে পারেন ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে ভুয়া নিয়োগ সুপারিশ দিয়ে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া এনটিআরসিএ’র মোবাইল নম্বরটি ক্লোন করে ফলাফলের ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছে। এভাবে শিক্ষকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করেছে জালিয়াতি চক্র। ভুয়া সনদ ও সুপারিশে শিক্ষক হয়ে এমপিও’র অর্থ আদায় করেছেন। এই ওয়েবসাইট এবং সনদ যাচাই করতে গিয়ে সন্ধান মেলে সনদ জালিয়াত চক্রের।

WhatsApp Image 2025-03-14 at 23.07.06জাল ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট। (বামে) অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি মাদ্রাসা ছাত্রের সহায়তায় জালিয়াতির তথ্য সামনে আসে

মাদ্রাসা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার পক্ষে ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’র শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল ইসলাম ৩৬ জন শিক্ষকের জাল সনদ শনাক্ত করেন এবং অবৈধভাবে নিয়োগ নেওয়ার তথ্য দেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের ওই সময়ের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন তথ্য অনুসন্ধান শুরু করেন এবং তার তথ্যের সত্যতা পান।

জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জালিয়াতি ও ভুয়া সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকরা চেষ্টা করেন তাদের চাকরি বাঁচাতে। কিন্তু আর লাভ হবে না। তারা চাইলেও আর বহাল থাকতে পারবেন না। আমি মাদ্রাসার শিক্ষকের জালিয়াতি নিয়ে কাজ করেছি, অধিদফতরকে সহায়তা করেছি। এখন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জাল সনদ নিয়ে কাজ করছি।’

জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার

জালিয়াত চক্রের সন্ধান পাওয়ার পর অধিদফতরের ওই সময়ের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন উদ্যোগ নেন জালিয়াত চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনার। ২০২৪ সালের ২ থেকে ৪ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তায় অভিযান চালিয়ে সনদ জালিয়াতির মূল হোতা দুইজনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। মূল হোতাদের তৃতীয়জন আইসিটির শিক্ষক হিসেবে পরিচিত সুমন নামে ব্যক্তিকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মো. আশরাফুল আলম এবং কাপাসিয়ার সোহাগপুর আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ ন ম আব্দুল্লাহ। আর এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার দত্তের বাজার কলেজের প্রভাষক স্বপন ব্যানার্জী। গ্রেফতার তিনজন এবং লাপাত্তা হওয়া সুমনসহ শাকিল আহমেদ, আব্দুস সালামের নামোল্লেখ করে আরও ৬ থেকে ৭ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে রমনা থানায় অধিদফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা  মো. নয়ন মিয়া বাদি হয়ে মামলা করেন।

মাদ্রাসা অধিদফতর জানায়, গ্রেফতার জালিয়াত চক্রের সদস্যরা জামিন নিয়ে জাল সনদধারী শিক্ষকদের ঐক্য গড়ে তুলছেন। যদিও এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের এমপিও বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাগুলোর অধ্যক্ষ বা সুপাররা অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ফলে অভিযুক্ত জালিয়াত শিক্ষকরা এমপিও বাতিল ঠেকাতে উচ্চ আদালতে যান। তবে তাতে লাভ হবে না।

ওয়েবসাইট জালিয়াতি ও মোবাইল নম্বর ক্লোন

মাদ্রাসা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়া জন্য বড় অংকের অর্থ আদায় করতো চক্রের হোতারা। সনদ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে প্রার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল বৈধ হিসেবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) টেলিটক মোবাইল নম্বর ক্লোন করে প্রার্থীদের ফলাফল ম্যাসেজের মাধ্যমে পাঠানো হতো। অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নামে নতুন ওয়েবসাইট খোলে জালিয়াত চক্র। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মো. আশরাফুল আলম, কাপাসিয়ার সোহাগপুর আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ ন ম আব্দুল্লাহ এবং সুমন নামে একজন আইসিটি শিক্ষকের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে সেখানে শিক্ষক নিয়োগের ভুয়া সুপারিশ আপলোড করা হতো। জাল সনদ পাওয়া শিক্ষকরা ভুয়া নিয়োগের সুপারিশ নিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় চাকরি করছেন।

মাদ্রাসা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, পলাতক সুমন কোনও একটি মাদ্রাসার আইসিটির শিক্ষক। তার পুরো নাম, ঠিকানা বা প্রতিষ্ঠানের নাম না পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা যায়নি ওই সময়। সুমন নকল ওয়েবসাইট তৈরি এবং মোবাইল ক্লোন করার কাজে জড়িত ছিলেন।

jal2

অভিযুক্তদের নিবন্ধনপত্র যাচাই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের চিঠি মাদ্রাসার দেড় শতাধিক শিক্ষকের সনদ ও সুপারিশ জাল

২০২৪ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর দেড় শতাধিক শিক্ষকের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল ও ভুয়া নিয়োগ সুপারিশ চিহ্নিত করে। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা হিসেবে এমপিও বাতিল করা হয়। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। দফায় দফায় আদেশ জারি করে এই নির্দেশ দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠান প্রধানরা অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেননি। পক্ষান্তরে শিক্ষকদের চাকরি বাঁচাতে মানবিক দাবি করেছেন অধ্যক্ষরা। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর বলছে, অনেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত আছে, আর সে কারণে জালিয়াত শিক্ষকদের বাঁচাতে চায়।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুল মান্নান নিউ ইর্য়ক ভয়েজ ২৪ কে বলেন, ‘আমি আশা করতে পারি না যে, শিক্ষকরা এমন অনৈতিক কাজ করতে পারেন। আমি এটা আশা করি না। আমি রাগ সংবরণ করে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকি। আমি কাজ করার চেষ্টা করছি। আমার সব ইচ্ছা তো প্রতিফলিত হয় না। দেখা যাক, আর কতটা করতে পারি।’

শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ও নিয়োগ সুপারিশ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের ওই সময়ের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘জালিয়াত চক্রের মূল হোতাদের মধ্যে সুমনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেফতার দুইজন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোকনগর দারুল হাদিস আলিম মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মো. আশরাফুল আলম জামিনে মুক্ত আছেন। জালিয়াতি থামাতে হলে এবং সরকারি অর্থ তছরুপ ঠেকাতে তিন হোতাকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। জাল সনদধারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ফৌজদারি মামলা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে মানবিক হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।

Related post